You are currently viewing অ্যাকোয়ামেরিন(Aquamarine Stone)
Benefits of Aquamarine stones

অ্যাকোয়ামেরিন(Aquamarine Stone)

অ্যাকোয়ামেরিন

আজ আমরা যে রত্ন পাথরেটি  সম্পর্কে আলোচনা করব সেটি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হওয়া সবচেয়ে ভিন্ন ধাঁচের একটি মূল্যবান পাথর।অ্যাকোয়ামেরিন পাথর। অ্যাকোয়ামেরিন শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ “অ্যাকোয়া” (aqua) যার অর্থ পানি এবং “মারিনা” (marina) বা সমুদ্র থেকে, যা এই পাথরের স্বচ্ছ নীল রঙের প্রতি নির্দেশ করে থাকে। এই পাথরটি বারিল (beryl) শ্রেণীর অন্তর্গত।  অ্যাকোয়ামেরিন সাধারণত  নীল থেকে গভীর নীল রঙ্গের হতে পারে এবং এটি কখনও কখনও সবুজ আভাও প্রদর্শন করে থাকে।

aquamarine stones price

অ্যাকোয়ামেরিন পাথরের ভৌত গঠন

অ্যাকোয়ামারিনের প্রাথমিক রং হিসেবে হালকা নীল থেকে গভীর নীলকে ধরা হয়।তবে কখনও কখনও সবুজ এটি আভার ও হয়ে থাকে।এই বৈচিত্রতার প্রধান অন্যতম কারণ এর অভ্যন্তরে থাকা আয়রন (Fe²⁺) এই পাথরটি মোহস স্কেলে সাধারণত  ৭.৫ থেকে ৮ পর্যন্ত হয়ে থাকে ।তাই এটি দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বেশ উপযুক্ত এবং টেকসই।

এর স্বচ্ছতা সম্পর্কে বলতে গেলে এটি  সাধারণত স্বচ্ছ থেকে অল্পস্বচ্ছ বৈশিষ্ট্যের হয়ে থাকে।অ্যাকোয়ামেরিনের ইনক্লুশন খুব কম পরিমাণ  থাকে, যা পাথরের স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখে।এটি দেখতে অনেকটা  ষড়ভুজাকার (hexagonal) আকৃতির হয়ে থাকে । ক্রিস্টাল সিস্টেমে এটি ট্রাইগনাল (trigonal)।অ্যাকোয়ামেরিনের  প্রতিসরণাঙ্ক (Refractive Index) ১.৫৭৭ থেকে ১.৫৮৩ এবং ডাবল রিফ্রাকশন: ০.০০৫ থেকে ০.০০৯ পর্যন্ত হতে পারে। মূল্যবান এই রত্ন পাথরটি প্রধানত পাঁচটি দেশে পাওয়া যায় ব্রাজিল (বিশেষত মিনাস জেরাইস অঞ্চল), নাইজেরিয়া, মাদাগাস্কার, রাশিয়া এবং পাকিস্তানে। এই পাথরের আকর্ষণীয় রং ,এর স্বচ্ছতা  এবং মজবুত ভিত্তি পৃথিবীবাসীর কাছে একটি মূল্যবান রত্ন পাথরে পরিণত করেছে ।

যুগে যুগে অ্যাকোয়ামেরিন পাথর

অ্যাকোয়ামেরিন পাথরের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।যুগে যুগে এই পাথর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।প্রায় প্রত্যেকটি যুগেই এই পাথর এক বিশেষ মর্যাদার স্থান দখল করে আছে।চলুন তাহলে সেই ইতিহাসই জানা যাক।

প্রাচীন যুগে অ্যাকোয়ামেরিন

প্রাচীন যুগে যেসব মূল্যবান রত্নপাথর ব্যবহার করা হতো তার মধ্যে একটি অন্যতম হল অ্যাকোয়ামেরিন। প্রাচীন যুগের প্রায় প্রত্যেকটি সভ্যতায় এই পাথর ব্যবহারের অস্তিত্বের সন্ধান মিলে।

রোমানরা এই পাথরকে একটি অত্যন্ত মূল্যবান রত্ন পাথর হিসেবে বিশ্বাস করত। তারা আরো ও বিশ্বাস করত যে এই পাথর তাদের  সমুদ্রের দেবতা নেপচুনের একটি প্রিয় বস্তু  এবং এটি সমুদ্রযাত্রায় নাবিক এবং বণিকদের সব ধরনের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে। তৎকালীন সময়ে নাবিকরা তাদের যেকোনো সমুদ্রযাত্রার আগে এই পাথর সঙ্গে রাখতেন  যেন তারা সকল ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারে। এছাড়া, রোমানরা এই পাথরকে ভালোবাসা ও বিবাহের প্রতীক মনে করত।এই পাথরকে তারা ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে ব্যবহার করতো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। 

রোমানদের মত প্রাচীন গ্রিকরাও অ্যাকোয়ামেরিন পাথরকে অত্যন্ত মূল্যবান রত্ন পাথর হিসেবে বিবেচনা করত। গ্রিকদের বিশ্বাস ছিল যে, বিবাহিত জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করতে অ্যাকোয়ামেরিন অনেক বড় ভূমিকা রাখে।এই পাথরকে তারা প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধনের প্রতীক রুপে বিবেচিত করত । প্রাচীন গ্রিসে যখন কোন বিয়ে হতো তখন আত্মীয় স্বজনরা নবদম্পতিরা এই পাথরটি উপহার দিতেন যেন তাদের পরবর্তী দাম্পত্য জীবন সুখের ও ভালোবাসাময় হয়। 

মিশরীয়রা ,রোমান এবং গ্রিকদের চেয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্যে এই পাথর ব্যবহার করত। রোমান এবং গ্রিকরা এই পাথরকে প্রেম এবং ভালবাসার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করলেও প্রাচীন মিশরীয়রা অ্যাকোয়ামেরিন পাথরকে আধ্যাত্মিক ও জাদুকরী ক্ষমতার উৎস হিসাবে ব্যবহার করত। তারা বিশ্বাস করত যে, এই পাথর তাদের জাদুকরী ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে সেই সাথে  দৃষ্টিশক্তি বাড়ায় এবং এটি বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখতো বলে তারা বিশ্বাস করত। মিশরীয় পুরোহিতরা বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানেও অ্যাকোয়ামেরিনের ব্যবহার করত। 

মধ্য যুগে অ্যাকোয়ামেরিনের ব্যবহার

প্রাচীন যুগের মত মধ্যযুগেও অ্যাকোয়ামেরিনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায। মধ্যযুগের সাধারণত অলংকার হিসেবে অ্যাকোয়ামেরিন ব্যবহার করা হতো।চলুন মধ্যযুগে অ্যাকোয়ামেরিনের বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
মধ্যযুগে ইউরোপে  সবচেয়ে বেশি অ্যাকোয়ামেরিনের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ইউরোপিয়ানরা চিকিৎসার জন্য ব্যাপকভাবে অ্যাকোয়ামেরিন ব্যবহার করত । তাদের বিশ্বাস ছিল যে, পাথরটির অভ্যন্তরীণ শক্তি রোগ নিরাময়ে কার্যকরী। বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসা দিতে তারা এই পাথরটি ব্যবহার করত  এবং চোখের বিভিন্ন সমস্যা নিরাময়েও তারা  অ্যাকোয়ামেরিনের সাহায্য নিত  । 

এছাড়া ও মধ্যযুগে অ্যাকোয়ামেরিন আধ্যাত্মিকতা ও বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।এর আধ্যাত্মিক গুণাবলীর জন্য তৎকালীন সময়ের যাজক ও ধর্মীয় নেতাদের কাছে পাথরটি দেখা যেত। 

মধ্যযুগে জ্যোতিষ চর্চার ক্ষেত্রেও অ্যাকোয়ামেরিন  ব্যবহৃত হতো । ইউরোপীয়  জ্যোতিষীরা বিশ্বাস করতেন যে এই পাথরটি মানসিক স্থিতি, ধৈর্য এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে ।তারা আরো বিশ্বাস করত এই রত্ন পাথর তাদের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য বিপদ থেকে রক্ষা করে । তাই এটি তারা সর্বদা তাদের কাছে রাখত। 

ইউরোপ থেকে এবার যাওয়া যাক মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে অ্যাকোয়ামেরিন পাথর সাধারণত তাবিজ এবং রক্ষাকবচ তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। আরবদের বিশ্বাস ছিল এই পাথর তাদের বিভিন্ন যাদু টোনা,অশুভ শক্তি এবং নেতিবাচক প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখে । এটি তারা  বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে এবং বিশেষ করে যুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো। যুদ্ধে যাওয়ার আগে  এই পাথর  দ্বারা সঙ্গে নিয়ে যেত যেন শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে।

আরবরা অ্যাকোয়ামেরিন প্রেম ও বিবাহের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করত । তারা বিয়েতে  নবদম্পতিদের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য বিয়েতে এই পাথর উপহার দিত ।শুধু ইউরোপ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে নয় এশিয়াতেও অ্যাকোয়ামেরিন ব্যবহারের ইতিহাস জানা যায়। এশিয়া মহাদেশ বিশেষ করে ভারত ও চীনে, অ্যাকোয়ামেরিন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য ব্যবহার করতো। তারা মূলত বিভিন্ন বিষক্রিয়া থেকে মুক্তি এবং মানসিক শান্তির জন্য এই পাথর ব্যবহার করত । ইতিহাস থেকে থেকে জানা যায় চাইনিজরা তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে এই রত্ন পাথর ব্যবহার করত ।

ভারতবর্ষে অ্যাকোয়ামেরিন ব্যবহৃত হতো আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ধ্যানের ধারক হিসেবে। ভারতীয়রা বিশ্বাস করত এই পাথর তাদের মনোযোগ ও ধৈর্য বৃদ্ধিতে উপযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখে।

তাছাড়া মধ্যযুগে অ্যাকোয়ামেরিন বিভিন্ন শিল্পকর্ম এবং গহনার মধ্যে বিশেষ স্থান দখল করে ছিল। এই পাথরের উজ্জ্বল নীল রঙ এবং স্বচ্ছতা একে গহনার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত করে তোলে। অ্যাকোয়ামেরিন ব্যবহারের প্রবণতা মধ্যযুগে বিভিন্ন রাজপরিবার এবং উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যেত  এবং তারা এটি বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করত ।মধ্যযুগে অ্যাকোয়ামেরিনের ব্যবহার এই রত্ন পাথরকে একটি বহুমুখী ও মূল্যবান রত্নপাথর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 

আধুনিক যুগে অ্যাকোয়ামেরিন পাথরের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সেই সাথে প্রাচীন এবং মধ্যযুগের চেয়ে আধুনিক যুগে এই পাথরের ব্যবহারের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিককালে এই পাথরটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, এবং এর জনপ্রিয়তা ও মূল্যওব্যাপকভাবে  বৃদ্ধি পাচ্ছে । চলুন নিচে আধুনিক যুগে অ্যাকোয়ামেরিন পাথরের উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যবহার সম্পর্কে জেনে নেই।

আধুনিককালে গহনা প্রেমীদের কাছে অ্যাকোয়ামেরিন পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে । এর উজ্জ্বল নীল রঙ এবং স্বচ্ছতা পাথরটিকে এক অনন্যতা দান করে সেই সাথে  বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তোলে। আংটি, কানের দুল, নেকলেস, ব্রেসলেট, এবং অন্যান্য অলংকারের জন্য অ্যাকোয়ামেরিন  একটি উৎকৃষ্ট রত্ন পাথর  এই রত্ন পাথর মধ্যবিত্তদের কাছে তেমন জনপ্রিয় না হলেও ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। আধুনিককালে এই পাথরকে ব্যক্তিত্ব এবং ফ্যাশন সচেতনতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে বর্তমান যুগে ক্রিস্টাল হিলিংয়ে অ্যাকোয়ামেরিন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সাথে এটি নিয়ে গবেষণা চলছে ।এই পাথর মানসিক শান্তি, ধৈর্য, এবং মানসিক স্থিতি প্রদান করতে পারে বলে বিশ্বাস করা হয়। এছাড়াও, উদ্বেগ ও স্ট্রেস দূর করতে অ্যাকোয়ামেরিন সাহায্য করে ।

আধ্যাত্মিকতা চর্চাতেও অ্যাকোয়ামেরিন পাথরের জুড়ি মেলা ভার।বিভিন্ন  আধ্যাত্মিক চর্চা, ধ্যান, এবং আত্মউন্নয়নে এই পাথর ব্যবহৃত হয়। এটি আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টি বৃদ্ধি করতে পারে বলে মনে করা হয়।

আধুনিককালে অ্যাকোয়ামেরিন পাথরের খনির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ব্রাজিল, নাইজেরিয়া, মাদাগাস্কার, রাশিয়া, এবং পাকিস্তানে উচ্চমানের অ্যাকোয়ামেরিন পাথর উৎপাদিত হচ্ছে। বিশেষত ব্রাজিলের মিনাস জেরাইস অঞ্চল থেকে পাওয়া অ্যাকোয়ামেরিন পাথর উচ্চ মানের হিসেবে বিবেচিত। 

যে সকল রাশির জন্য অ্যাকোয়ামেরিন  ব্যবহার করা উত্তম-বিস্তারিত

Leave a Reply